মেহেদি এর উপকারিতা ও ঔষধি গুনাগুন বৈজ্ঞানিক নামঃ Lawsonia inermis Linnপরিবারঃ Lythraceaeইংরেজি নামঃ Henna, Samphire. পরিচিতি মেহেদির কথা মনে...
মেহেদি এর উপকারিতা ও ঔষধি গুনাগুন
বৈজ্ঞানিক নামঃ Lawsonia inermis Linnপরিবারঃ Lythraceaeইংরেজি নামঃ Henna, Samphire.
পরিচিতি
মেহেদির কথা মনে হতেই প্রথমে মনে পড়ে মেহন্দি রাঙা হাতের কথা। এটি ঘন শাখা ও পাতাবিশিষ্ট একটি গুল্ম, ২-৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। এটির অনেক কাব্যিক নাম রয়েছে, যেমন- মদয়ন্তিকা, নিরিমুল্লকা বা বনমল্লিকা। সুশ্রুত সংহিতায় বলা হয়েছে নখরঞ্জিকা।
বিস্তিৃতি
মেহেদি এর আদিবাস উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। রঙের জন্য ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মেহেদির চাষ হয়। বেড়া হিসেবে এটি রোপণ করা হয়। বাংলাদেশে এটি প্রায় সব এলাকেতেই দেখা যায়।
বীজ আহরণ ও বংশবিস্তার
বর্ষাকালে প্রাপ্তবয়ষ্ক গাছে সাদা বা গোলাপি রঙের ছোট ছোট অসংখ্যা ফুল দেখা যায়। লম্বা পুষ্পদন্ডের চারদিকে ছোট বোঁটাবিশিষ্ট ফুল হয়। আকন্দ, সর্পগন্ধা ও ধুতরার মতো একই সময় ফুল ও ফল দেখা যায়। প্রায় মটরদানার আকারের ধূসর বর্ণের ফলের ভিতর ছোট ছোট ৫৮-৯৫টি বীজ থাকে। বীজ অথবা অঙ্গজভাবে (শাখা কাটিং) মহেদীর বংশবিস্তার সম্ভব। তবে কাটিংয়ের সাহায্যে নতুন চারা উৎপাদন সহজ বলে আমাদের দেশে এ পদ্ধতিই অবলম্বন করাহয় এবং এ ক্ষেত্রে শতকরা ৭০-৮০টি চারা সহজেই পাওয়া যায়। সাধারণত ৬ মাসের কাটিং রোপণের জন্য উপযুক্ত এবং ৪/৫ বছরের গাছ থেকে পাতা আহরণ শুরু করা যায়।
বীজ সংগ্রহের সময়
আগষ্ট-সেপ্টম্বর। বীজের ওজন প্রতি কেজিতে প্রায় ১ মিলিয়ন।
রাসায়নিক উপাদান
পাতা ও ছালে অনুজীব ধ্বংসী রঙ্গিন ন্যাথোকইনোন দ্রব্য, প্রচুর পরিমাণ ট্যানিন, কিছু গ্লাইকোসাইড, স্টেরল ও টার্পিন বিদ্যমান।
বিভিন্ন অংশের ব্যবহার
ব্যবহার্য অংশ
মেহেদী গাছের ছাল, পাতা, বীজ ও ফুল ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ ব্যবহার
হেনার সবচে সাধারন ব্যবহার হল রঞ্জক পদার্থ হিসাবে চুলে এবং হাত ও পায়ের ডিজাইনে, উলকি (টাট্টু আর্ট) অংকণে। কন্ডিশনার হিসাবেও এটার সাধারণ ব্যবহার রয়েছে। হেয়ার টনিক, হেয়ার কন্ডিশনার বা নারিসার ও হেয়ার ক্লিণজার বা সেম্পু হিসাবে ব্যবহার হয়। ফুলের তেল পারফিউম হিসাবে ব্যবহার হয়। সতেজ পাতার পেস্ট বা পাতার পাউডার উভয় আকারেই ব্যবহার করা যায়। পাওডারের সাথে লেবুর রস, চা বা ইউক্যালিপটাস পাতা মিশিয়ে ব্যবহারে কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
বিদ্যমান ফাইটোকেমিক্যাল
হেনার পাতায় রয়েছে এক প্রকার লালচে-বাদামি গ্লাইকোসাইড রঞ্জক লসোন ও টেনিন উদ্ভুত হেনোটনিক এসিড। পেট্রোলিয়াম ইথার শোষনের মাধ্যমে বীজ হতে উচ্চ-সান্দ্রতার তৈল পাওয়া যায় যাতে রয়েছে বিহেনিক, অ্যারাসিডিক, স্টিয়ারিক, পালমেটিক, ওলিক ও লিনোলিক এসিড।
ঔষধি গুণ
১। ইউনানি চিকিৎসকদের মতে চুল উঠে যাওয়া বা পাকায় ১টি হরীতকী ও ১০/১২ গ্রাম মেহেদির পাতা একটু থেঁতো করে ২৫০ মি.গ্রা. পানিতে সিদ্ধ করে ৬০-৭০ মি.লি থাকতে নামিয়ে ছেঁকে ঠাণ্ড হলে মাথায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
২। শ্বেতপ্রদরে (Leucorrhoea)) ২৫গ্রাম মেহেদি পাতা সিদ্ধ করে সেই পানিতে উত্তবস্তি (ডুস দেওয়া) দিলে সাদা স্রাব ও অভ্যন্তরের চুলকানি প্রশমিত হয়। স্তানভ্রষ্ট জরায়ুর (Displacement of Uterus) ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অসুবিধা কমে যায়।
৩। শুক্রমেহ রোগে মেহেদির পাতার রস এক চা চামচ দিনে দু বার পানি বা দুধের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে উপকার পাওয়া যা।
৪। মেহেদির পাতা ও চালের ছত্রাক ও রোগজীবাণুনাশক গুণ রয়েছে (Ali,1996); মুখ ও গলার ক্ষতে পাতা সিদ্ধ পানি মুখে খানিক্ষণ রাখলে সেরে যায়।
৫। গ্রীষ্মকালে ঘেমে গিয়ে গায়ে দুর্গন্ধ হলে মেহেদি পাতা ও বেনামূল (Vetivera zizanioids) সিদ্ধ পানিতে গোসল করলে উপকার পাবেন।
৬। কানে পুঁজ হলে এ পতার রস ২ ফোঁটা করে কানে দিলে ৪/৫ দিনে পুঁজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
৭। চোখ ওঠায় অল্প কয়েকটা পাত থেঁতো করে গরম পানিতে ফেলে ছেঁকে সেই পানির ফোঁটা চোখে দিলে সেরে যায়। এমনকি চোখের কোন থেকে পুঁজের মতো পড়তে থাকলেও এটি ব্যবহারে সেরে যায়।
৮। প্রাচীনপন্থী বৈদ্য সম্প্রদায়ের মতে শরীরে হিমোগ্লোবিন সঠিক পরিমাণে আছে কিনা জানার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। মেহেদির পাতা বাটা হাতের তালুতে লাগালে রংটা লালচে আভা দিলে ভালো, না হলে হিমোগ্লোবিন কম আছে বলে ধারণ করা হয়।
৯। আগের দিনে নবাব বাদশাহদের অনিদ্রা রোগ হলে মেহেদির ফুলের বালিশে ঘুমানোর রামর্শ দেওয়া হত। এতে আছে লাইলাকের (এক প্রকার প্রসিদ্ধ সুগন্ধি) গন্ধ। চরক সংহিতায় বলা হয়েছে-গন্ধটি পার্থিব সত্তয় সমৃদ্ধ।
১০। যে কোনো ধরনের চর্মরোগ, খুশকি ও মাথাব্যথায় মেহেদি পাতার প্রলেপ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। (Ghani, 2003) এটি বায়ু বাহিত হয়ে নাসারন্ধ্র পথে মস্তিস্কে উপস্থিত হয় এবং ইড় -পিঙ্গলাকে একীভূত করে সুষ্মায় পৌঁছে দেয়। তখনই মনে হয় অন্তর্মুখী, সেটােই নিদ্রার পূর্বরুপ। আস্তে আস্তে আসে স্নায়ুতন্ত্রের অবসাদ, তারই বাস্তবরুপ তন্দ্রা।
অন্যান্য ব্যবহার
ঔষুধি ছাড়াও প্রসাধনে মেহেদি খাতি আজ আর শুধু প্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।ভারত-বাংলাদেশসহ সুদূল ইউরোপেও প্রসাধনী হিসেবে এর কদর রয়েছে আজকাল। হত-পা ও মাথার চুল রাঙাতে বৈচিত্র্যময় আলপনায় ব্যবহার হয় মেহেদি।
COMMENTS